বাংলাদেশের জন্য টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পথ ও পাথেয়
কৃষিবিদ মো: হামিদুর রহমান
চলতি বছর আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপন করছি। বিশ্ব জুড়ে কোভিড-১৯ অতিমারির ভয়াবহ অবস্থা সত্ত্বেও বাঙালি জাতি এ বছরটিতে নানা বর্ণে ও মাত্রায় স্মরণ করছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ও জাতির পিতার চিরস্মরণীয় অবদান খচিত জীবনালেখ্য। সংগতকারণেই সকল আয়োজনে ওঠে আসছে এ দেশ ও জনগণের শত সহস্র বছরের পেছনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপমৃত্যু ছিল এই গাঙ্গেয় বদ্বীপটিতে বসবাসকারী মানুষের এক অনিবার্য ললাট লিখন। সম্পূর্ণ প্রকৃতিনির্ভর কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং শোষণ ও নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থাই ছিল এই ললাট লিখনের পশ্চাতভূমি। মাত্র ৭৮ বছর আগে ১৯৪৩ সালে ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষে অবিভক্ত বাংলায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনামলের বাঙালি জাতির জীবনের এক মর্মন্তুদ বর্ণনা পাই আমরা জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায়..
“...চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে মেয়ে
মাতা কন ওরে চুপ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ চেয়ে!
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা বয়ে যায় খাইনিকো বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন,
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়! কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছ কি?
কলি ও চুন কেন ওঠে নাকো তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?
আমরা তো জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছে খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস।
এলো কোটি টাকা, এলো না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!...”
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের “রবীন্দ্রনাথের প্রতি” কবিতায় ফুটে উঠেছে অনাহার দুর্ভিক্ষ নিয়ে সংক্ষোভের আর এক বেদনাÑ বিধুর চিত্র।
“...আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়...”
এসব বর্ণনা থেকে আমরা এদেশের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের শতসহস্র বছরের যাপিত জীবনের যে যন্ত্রণাকাতর প্রতিচ্ছবি পাই- সেটাই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণের যাঁতাকলে সৃষ্ট ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার সংগ্রামী প্রত্যয়ের মধ্যে। এই সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ও মুক্তিযুদ্ধে ব্রতী করার অনন্য নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং আত্মনিয়োগ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সূত্রেগাঁথা এবং চির অবিভাজ্য এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
ক্ষুধামুক্তির পথ অন্বেষণ ও নীতি কাঠামোগত প্রস্তুতি
এ বছর যখন আমরা নানা বর্ণে ও বিভায় ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ ও ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপন করছি এবং এই উদ্যাপনের পরম্পরায় পেছন ফিরে দেখা এবং সম্মুখে এগিয়ে চলার কর্তব্য স্থির করছি-তখন ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তি তথা টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের বিষয়টিই যে অন্যতম প্রধান এজেন্ডা হবে- সেটাই স্বাভাবিক। সংগতকারণেই বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ প্রণীত সংবিধানের অধ্যায় ১৫ (ক) তে মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা বর্ণনায় “অন্ন” তথা খাদ্যের বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং অধ্যায় ১৮ তে জনগণের “পুষ্টির স্তর উন্নয়নের” কথা বলা হয়েছে। জাতির পিতার নেতৃত্বে প্রণীত এই সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার হিসেবে পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের নিশ্চয়তা বিধানের অঙ্গীকার করা হয়েছে।
এই অঙ্গীকারের প্রতিধ্বনি ব্যক্ত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এর অভিলক্ষ-২এ। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের সার্থক উত্তরসূরী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে এ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। যার অর্থ হলো বাংলাদেশের আপামর জনগণের জন্য একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার বলয় রচনা করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল করণীয় স্থির করা এবং তা সম্পাদনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ লক্ষ্য অর্জনে বিস্তারিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তি তথা পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে সরকার ২০২১-২০৪১ মেয়াদে (চবৎংঢ়বপঃরাব চষধহ ২০৪১) প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, এসডিজির এজেন্ডাসমূহে যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেই সাথে ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চতর মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
আমাদের বর্তমান কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি ইতঃপূর্বে খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় ২০১৩ সালে এ দেশে ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আইন’ প্রণয়ন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠনে অবদান রাখেন। ভূমণ্ডলীয় পরিসরে নিরাপদ খাদ্যের সনদ গ্রহণযোগ্য করার জন্য অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ডও গঠন করা হয় ২০১৫ সালে।
অতিসম্প্রতি ‘ জৈব কৃষি নীতি’ ও ‘উত্তম কৃষি চর্চা নীতি’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে নবায়িত জাতীয় কৃষি নীতির উপর ভিত্তি করে ২০২০ সালে জাতীয় কৃষি নীতির বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। ‘জৈব কৃষি নীতি’ ও ‘উত্তম কৃষি চর্চা নীতি’ সামগ্রিকভাবে কৃষি নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ সকল নীতি বাস্তবে রূপ দেয়ার সকল আয়োজন চলছে। তাই এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে পথ ও পাথেয় প্রস্তুতির কাজ অনেকাংশে সম্পন্ন হয়েছে।
লক্ষ্য অর্জনের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পথগুলো হচ্ছেÑ ক) লক্ষ্য উদ্দেশ্যাবলী নির্ধারণ করা; খ) প্রয়োজনীয় নীতি কাঠামো প্রস্তুত করা; গ) উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ জনবল নিয়োগ করা; ঘ) প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে কার্যকর আন্তঃসমন্বয়ের কর্মধারা সৃজন ও চালু রাখা; ঙ) দক্ষ কৃষক ও তাদের সুগঠিত সংগঠন পরিচালনা করা; চ) কৃষকবান্ধব বাজারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা; ছ) কৃষি শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ, উপকরণ ও পণ্যের বাজারব্যবস্থা এবং দক্ষ কৃষক তাদের সংগঠনের কার্যক্রম সুদৃঢ় আন্তঃসমন্বয় করা এবং পাথেয়গুলো হচ্ছে- ক) নিরন্তর গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি উদ্ভাবন; খ) গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি/উদ্ভাবনসমূহের সফল প্রয়োগ; গ) বাজারব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন তথা কার্যকর সরবরাহ শেকল প্রতিষ্ঠা করা; ঘ) বাজারব্যবস্থার (উপকরণ ও পণ্যভিত্তিক) সাথে উৎপাদক কৃষক সাধারণের লাভবান হওয়ার উপযোগী কার্যকর সমন্বয় সাধন; ঙ) জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য-পুষ্টি সচেতনতা সৃষ্টি; চ) জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধির রাষ্ট্রীয় আয়োজন।
উল্লিখিত পথ ও পাথেয় অবলম্বন করে প্রণীত কর্ম-পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নতুন গতিসঞ্চার করবে এবং আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণে সফলকাম হবো।
লেখক : সদস্য, এপিএ পুল, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাক্তন মহাপরিচালক, ডিএই। মোবাইল : ০১৭১১৮০৩৬৯৫, ই-মেইল : hamidur2152@gmail.com